নাম তার “মায়া”

আমার মত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যাদের দশকে একবার; ৫২ বছরে মাত্র ৬ বার সমাবর্তন তো পরের বিষয়, শ্রেণীকক্ষেই শিক্ষক অনিয়মিত আসেন তাদের জন্য সমাবর্তন হয়ত খুবই বিশেষ একটি দিন। কিন্তু সংগত কিছু কারণে এ নিয়ে আমার উত্তেজনা ছিল না, আগ্রহ ছিল। আশেপাশের প্রায় সবাই তাদের মা-বাবাকে নিয়ে আসলেও স্বাস্থ্য ঝুঁকির ব্যাপারটা মাথায় রেখে এরকম জনবহুল জায়গায় আমার মা-বাবাকে আনতে একদমই ইচ্ছে হয় নি। তাছাড়া ইতোমধ্যে শিক্ষাজীবন শেষ করবার আগে আগে ছেলের প্রথম কর্মস্থলে প্যারেন্টস ইনিসিয়েশন পেয়ে যাওয়ায় তাদেরও আগ্রহ ছিল কম। ছোটবেলা থেকেই আমার ছোটো ছোটো অর্জনে বাবা-মাকে যে পরিমাণ গর্ব করতে দেখেছি সেটা জীবনের বড় পাওয়াগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

সমাবর্তনের আগের দিন, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার বিকেলে ভাবনাকে দেখলাম ওর দিদা আর মাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। সবাইকে একসাথে ভীষণ ভালো লাগছিল দেখতে। ওর দিদাকে দেখে আমার দিদার কথা মনে পড়ছিল ভীষণ। খুব মিস করছিলাম সারা সন্ধ্যা জুড়ে। মা'র পরে যে ভদ্রমহিলা কোনও স্বার্থ ছাড়া আমাকে সবটুকু দিয়ে ভালবেসেছেন তিনি আমার দিদা। নাম ‘মায়া’। পুরনো প্রজেক্টরের পর্দায় বৃষ্টির ফোটার মত ছোপ ছোপ দাগ পড়া সিনেমার দৃশ্যের মত নিজের ছোটবেলার মুহুর্তগুলো অনবরত চোখে ভাসছিল৷

হাত ধরে আমাকে প্রথম স্কুলে নিয়ে যাওয়া, প্রথম ভর্তি করানো, জীবনের প্রথম ভাইফোঁটা, যেখানে যেতেন সাথে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া- সব দিদার হাতে। অনিকের জন্মানোর পরে বাঁধন আরও পোক্ত হল যখন মা আমাদের দুজনকে একহাতে সামলাতে পারছিলেন না বলে দিদা তার নিজের কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন। সারা বেলা দিদার হাতের দুটি আঙ্গুল ধরে ঘুরতাম। পূজা-পার্বণে হরেক রকম পিঠা-পুলি-সন্দেশের মেলা বসতো ঘরে শুধু নাতীদের খাওয়াবেন বলে। দিদার হাতে বানানো নানান নতুন নতুন সব দেশি রেসিপির খাবার খেতাম। রাতে জড়িয়ে ঘুমাতাম। দিদার গায়ের গন্ধ ছিল মা'র পরে সবচেয়ে আপন। খুব প্রিয়। নাকে পেলেই মনে হত দুনিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় আছি।

আমার আসলে জন্মানোরই কথা ছিল না! জন্মানোর পরে বাঁচানোটাও ভীষণ সংগ্রামের ছিল!

সে জন্মরাতে দিদা-দাদু হন্য হয়ে এলাকার ধাত্রী-নার্সদের বাসায় গিয়ে খুঁজে আনার জন্য সারারাত দৌড়াচ্ছিলেন। শেষে ধাত্রী পাওয়া গেলেও মার প্রসব বেদনা তখন তুঙ্গে। গর্ভে ঠিকঠাক ছিলাম না! গুরুবার ছিল সেদিন। পাড়ার লিটন মামাদের ঘরে গুরু-উপাসনা মাত্র শেষ হল। দাদু নিরুপায় হয়ে শেষ আশা নিয়ে উপাসনার প্রসাদ এনে মার মুখে দিলেন। মিনিটের মাথায় এলাম আমি। জন্মের কমাস যেতেই শিশু ডায়রিয়ায় প্রায় মরতে বসেছিলাম। মফস্বলের মেয়ে, গ্রামে নতুন বিধায় মা'ও বুঝে উঠতে পারছিলেন না, তক্ষুনি আমার অসুস্থতার খবর শুনে এক শাড়িতে মা'কে নিয়ে সে বার সারাজীবনের জন্য গ্রাম থেকে বের হলেন। চট্টগ্রাম শহরে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করেই ফিরলেন। সে যাত্রায়ও বেঁচে গেলাম একমাত্র দিদার জন্য। তারপর ধীরে ধীরে গুছিয়ে দিয়েছিলেন মা-বাবার গোটা সংসার।

ভীষণ দুষ্টুমি আর আনন্দ হই-হুল্লোড়ে দিন কাটাতে পছন্দ করতেন দিদা। ছিলেন বেশ সৌন্দর্য সচেতন। নখে নেইলপালিশ, পায়ে আলতা, চুলের আগায় পরচুলা, মুখে স্নো-পাউডার; ঘর থেকে ঘুরতে বেরোলে এসব পরা লাগতই। উৎসব পার্বণে দিদার বরাবরই অনেক আগ্রহ উদ্দীপনা। একবার গ্রামের বাড়িতে বড় দা'র বিয়েতে দিদা চলে গেলেন আগে আগে। মেয়ের ভাসুরের ছেলের বিয়ে তো কি হয়েছে! উৎসাহে বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই। সেই অজোপাড়ায় যেখানে বিদ্যুতের আলো তখনো পৌঁছায় নি, সেখানে পায়ে আলতা, নখে নেইলপালিশ, মুখে স্নো-পাউডার, গায়ে সুগন্ধি মেখে লাল টুকটুকে আটপৌরে শাড়ি পরা রমণী একা একাই বাস-টেম্পোতে চড়ে পৌঁছে গেলেন। আর বাড়ির দিদি-বৌদিরা দিদার অমন বয়সে নিজেদের বয়সীদের মতন কেতাদুরস্ত থাকতে দেখে চোখ কপালে!

গান শিখতে-গাইতে ভালো লাগতো না আমার। স্কুলে যেতেও না। বুঝিয়ে-সুজিয়ে দিদাই স্কুলে পাঠাতেন, গান শিখাতে পাঠাতেন। গর্ব করে বলতেন, "আমার ভাইয়া একদিন মার্চেন্টসে পড়বো। অনেক বড় হইবো। গান করবো, উপাসনা করবো"। আই উইশ, বড় হবার পরে আমার গান আমার দিদাকে শুনাতে পারতাম! আই উইশ! অন্তত একবার! দেখাতে পারতাম আমার সব অর্জনগুলো। অনেক গর্ব করতেন! অনেক খুশি হতেন। ভাবনার মা আর দিদাকে নিয়ে এত সুন্দর একটা মুহূর্ত না দেখলে হয়ত দিদাকে অতটাও মিস করতাম না। সৃষ্টিকর্তা ওর দিদা আর মা'কে অনেক আয়ু দিন, সুস্থ রাখুক।

ছোটভাই হবার পরে মা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন বিধায় ছোটবেলায় মা'র চাইতেও দিদার কাছে বড় হওয়ার স্মৃতি বেশি আমার। উনি যতটা না ভালোবাসা দেখিয়েছেন, তার চাইতেও কতটা সুন্দর করে সবাইকে আগলে ধরে রাখা যায়, সেটা শিখিয়েছেন সারাজীবন। চোখের জলও তাই কম ফেলেন নি। স্পষ্ট মনে আছে। ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন। মেজো ছেলে আর ছেলে বউকে বিয়ের পরে যেদিন আলাদা করে দিলেন, সেদিন হাঁটতে হাঁটতে কান্নার জল আঁচলে মুখ মোছা এখনো মনে পড়ে। বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কে কী বলে কষ্ট দিয়েছে সেসব কথা বাসায় এসে মাকে বলাটাও। বড় বউ দিদাকে বকলম বলেছিলেন। জেদে তড়িঘড়ি করে সেদিনই মার কাছে এসে স্বাক্ষর করা শিখে গেছিলেন। এত এত মানুষ উনাকে চেনে-ভালোবাসে কীভাবে তা ভেবেই অবাক লাগতো!

হাই স্কুলে উঠবার পরেই আমাকে ছেড়ে চলে যান দিদা। দিদার ইচ্ছে ছিল তার মেয়ে-জামাই আর নাতীর কাছে শেষ শ্বাস ফেলবেন। হয়েছিলও তাই। আমার জীবনে দেখা প্রথম মৃত্যু। তাকিয়ে আছি মুখখানির দিকে। টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে মাথাটা একপাশ হয়ে গেল। চোখ বন্ধ। জীবনের শেষ দৃষ্টিটা বুজে গেল। সিঁদুর রাঙা ধবল ফর্সা সে মুখ। লোকে বলতো স্বামীর আগে স্ত্রী গেলে নাকি স্বর্গবাসী হন। দিদা নিজেই তো এক ভালোবাসার স্বর্গ, নিশ্চয়ই স্বর্গেই গেছিলেন। ওদিকে দাদুও তার ‘মায়াকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারেন নি। বছর না পেরোতেই বাৎসরিক শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন করে হার্ট এটাকের ছুতোয় প্রথম ধাক্কাতেই মায়ার টানে পাড়ি জমালেন আপন মায়ালোকে।

কি অদ্ভুত সে মায়া!

গ্রামের বাড়িতে আজ ৩০ বছর পরে আমাদের নিজেদের ঘর হচ্ছে। উত্তরে ছোট পুকুর আর ইটের রাস্তা সামনে রেখে আমগাছের ছায়ায় পুবপাশের পুকুরের টলমলে জলের পাড়ে একটি ছোট্ট মাথা গোজার ঠাঁই। নিঃস্বার্থ ভালোবেসে আঁকড়ে বাঁচিয়ে রাখা সে মহীয়সীর নামেই ছোট্ট সে ঘরের নাম রাখা হল- ‘মায়া

কথাগুলো যখন লিখছি, মাথায় তখন বাজছে ইমন চৌধুরীর সঙ্গীতায়োজনে আলেয়া বেগমের গাওয়া গানটি -






Comments

Popular posts from this blog

সুরের ভেলার ভেসে চলা - সঙ্গীতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ(ভারতীয় সঙ্গীত) : শুভ কর্মকার

সে এক কিশোরের গল্প - শুভ কর্মকার

আমার-আপনার বাঙালির রবি নজরুল... - শুভ কর্মকার