শুভ জন্মাষ্টমী

কোন রাধা-কৃষ্ণকে পূজছেন আপনি?

শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি আজ। শুরুতেই বলে রাখি, একটা সময় পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণ বরাবরই আমার অপছন্দ ছিলেন। কারণটা হল প্রচলিত রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের বা কামনা-বাসনার গল্প আমার মোটেও ভালো লাগে নি। কিন্তু মহাভারত জানার পরে কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণের যে রূপ পাই, তা ছিল পুরোই উলটো। তিনি বন্ধু, শিক্ষক, সন্তান, অথবা শাসক চরিত্র- সব জায়গাতেই সেরা, অতুলনীয় এবং অনুকরণীয়।

এবার মূল ঘটনায় ফিরি...

Wiki অনুযায়ী ধারণা করা হয় উনার জন্ম খ্রিষ্টের জন্মের কমপক্ষে ৮/৯ম শতাব্দী পূর্বে। মহাভারত নামে যে গ্রন্থটিতে তার বিবরণ লেখা, তার রচনা হয়েছিল কমপক্ষে খ্রিষ্টপূর্ব ৩/৪র্থ শতাব্দীতে। মহাভারত ছাড়াও শ্রীকৃষ্ণের জীবনকাহিনী যে দুটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে লেখা তার একটি হল 'হরিবংশ' আরেকটি হল 'শ্রীমৎ ভাগবত'। আশ্চর্য লাগলেও সত্য যে, তিনটি গ্রন্থের কোথাও শ্রীকৃষ্ণের সুদীর্ঘ ১২৫ বছরের জীবনে ‘রাধা’ নামক কোন নারীর অস্তিত্ব বিশেষভাবে পাওয়া যায় নি।

মজার বিষয় হচ্ছে, জন্মের মাত্র সাত থেকে দশ বছর পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে ছিলেন, যখন রাধার বয়স উনিশ থেকে বাইশ বছর। রাধা নামে যাকে পাওয়া গিয়েছিল তার সাথে কোনোভাবেই শ্রীকৃষ্ণের সরাসরি সম্পর্ক ছিল না। মধ্যযুগীয় কবিরা তাদের লেখায় প্রাপ্ত বয়স্ক নায়ক-নায়িকার যে কাম-বাসনা দেখিয়েছেন তা ৭-১০ বছরের বাচ্চা ও ১৯-২২ বছরের নারীর ক্ষেত্রে অমূলক। এ সকল প্রসঙ্গে বঙ্কিম চন্দ্র তার ‍"কৃষ্ণ চরিত্র" গ্রন্থে এক বিশাল বিশ্লেষণ উত্থাপন করেছেন।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে রাধা আসলো কোথা থেকে?

কাম-বাসনাযুক্ত প্রেমিক-প্রেমিকারুপী যে রাধা-কৃষ্ণ আমরা আজ দেখি খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের তার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেলেও মধ্যযুগে এসে নানান সাহিত্যিকদের রচনায় স্পষ্ট হয়ে ফুটেছিল। তারা ঈশ্বর-ভক্তের প্রেমকে প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। বড়ু চণ্ডিদাসের 'শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন'ও তেমনি একটি গ্রন্থ যার গোটাটাই তিনি নিজের মনের কল্পনা থেকে লিখেছিলেন।

মূলত হিন্দুরা যে ‘রাধা-কৃষ্ণ’কে এত এত পূজা-নাম-কীর্তন করে সে ‘রাধা’ মূলত একটি ভক্তের “ধারণা/Concept” ছাড়া আর কিছুই না। ‘রাধ’ ধাতু থেকে রাধা নামের উৎপত্তি। 'রাধ' ধাতুর অর্থ হচ্ছে আরাধনা করা। যিনি সৃষ্টিকর্তাকে আরাধনা করেন তিনিই রাধা। মানে ঈশ্বরভক্ত সবাই রাধা। ভক্তের জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা থাকে ভগবানের সাথে মিলিত হওয়ার। রাধা-কৃষ্ণের “যুগল-রূপ” হচ্ছে ভক্ত ও ভগবানের বা জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন রূপের প্রতীক। Radha is considered a metaphor for the soul. Her longing for Krishna is theologically seen as a symbol of the longing for spirituality and the divine.

আজকে কথাগুলো বলছি এ কারণে যে, টিভি-বেতার, অন্য ধর্মালম্বী তো বটেই এমনকি হিন্দুদের মননে যেভাবে কৃষ্ণকে কামরূপী প্রেমের অবতার দেখিয়ে লীলা স্মরণ করতে দেখি, ব্যাপারটি খুবই নোংরা এবং অবান্তর। মানুষ নিজের প্রয়োজনে ধর্মকে নানানভাবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত, তারই প্রতিফলন হয়েছে শ্রী কৃষ্ণকে নিয়ে যার কোনো ভিত্তিই নেই। অন্তত বর্তমান সময়ে এসে বৃন্দাবনের প্রেমলীলারত শ্রীকৃষ্ণের চাইতে কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণকে আরাধনা এবং ধারণ করাটা খুব বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।

জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা।



Comments

Popular posts from this blog

সুরের ভেলার ভেসে চলা - সঙ্গীতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ(ভারতীয় সঙ্গীত) : শুভ কর্মকার

সে এক কিশোরের গল্প - শুভ কর্মকার

আমার-আপনার বাঙালির রবি নজরুল... - শুভ কর্মকার