বাংলা গান এবং আমি

যিনি মহাকাশের রবির মতই সাহিত্য ও সংগীতের গগনে প্রোজ্জ্বল আমার কাছে সেই আদি ঋষিকবি হলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। যার রচনার ভাব-আবহ আরাধনার মত, আছে জীবনের সব কিছুতে কাউকে নিয়ে নিবিড় অনুধাবন। সে হতে পারে পরমাত্মা কিংবা প্রিয়তমা। কেমন যেন সব ছেড়ে তাতে নিজেকে সমর্পণ! যেমনটা প্রসূন যোশীর কথায়, "meraa yaar hai rab vargaa, Dildaar hai rab vargaa, Ishq karun yaa karun ibaadat, Ekko hi gal ai.." কিন্তু সে সমর্পণে আছে প্রচুর প্রাচুর্য, আভিজাত্য। যাকে এক কথায় বলবো The Great Bengali Aristocracy. আজ পর্যন্ত কবিগুরুর যতগুলো গান শুনেছি, মনে ধরে নি বলে কখনই কোনোটা মনে হয় নি। তার মত প্রাচীনত্ব ও আধুনিকতার সুবিন্যস্ত মিশ্রণ ভীষণ দূর্লভ। তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বাঙালির আশীর্বাদ এবং সর্বনাশ।

অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত এবং ডিএল রায়- ৩ জনেরই লেখনী ও সুর ব্রাহ্মসমাজের স্তুতির মত, গম্ভীর যে ভাবের ছন্দ। মাঝেমধ্যে মনে হয় মর্ত্যলোকে ব্রহ্মা-পূজার প্রচলন থাকলে তাদের গানগুলোই ব্যবহার করে তুষ্ট করা হত।

আর যারা বলেন অভিমান শুধু মেয়েদেরই থাকে, তারা নজরুলের লেখাগুলো পড়ে দেখতে পারেন। বাংলা গানে গজল, কাওয়ালী, শ্যামা সংগীত- তারই আনা। তার রচনায় প্রেম যেমন গভীর, অভিমান তেমনি দুর্বোধ্য। উপাসনালয়ে নিষিদ্ধ বস্তু নিয়ে ঢুকে উলটো বর নিয়ে বেরোবার ক্ষমতা একমাত্র বোধহয় তারই আছে। দোষে-গুণ মিলিয়ে সত্যিকারের ভালো মানুষ কেমন হতে পারেন, তার উদাহরণ নজরুল। যে হাতে কলম উঠেছে, সে হাতে অস্ত্রও উঠেছে। আবার প্রার্থনায় একসাথে যে দু হাত উঠেছে, সে হাতে পূজাও হয়েছে। সে সময়কার প্রথা ও প্রথাগত লেখনী আবেগ থেকে বেরিয়ে সরাসরি কাউকে সবটুকু দিয়ে মনের কথা খুলে বললেন তিনি। নজরুল মানে প্রবল কামনায় নিদারুণ চেষ্টায় কাছে চেয়ে না পেয়ে কষ্টে ভৎসনা। যার কাছে প্রিয়া মানে মহাজাগতিক সব অলংকার দিয়ে খোশখেয়ালে বানানো প্রাণদায়ী প্রতিমা। যার খুঁটিনাটি কবির জানা। আর তাতে নেই কোনো গরিমা। দেবী বলে ব্যাথার ক্ষোভে আসন থেকে তাকে নামিয়ে রাক্ষসী বলতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন না।

আর তাই হয়ত কিশোরী মনে নজরুলের চাইতে রবীন্দ্র-রচনা দাগ কাটে বেশি।

এর মাঝে অনুরক্ত হলাম সুফি আর কাউয়ালিতে। ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনের সময় আফগান থেকে জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি সুফি গানের ঘরানা নিয়ে আসলেন। তারপর পরেই নিজামুদ্দিন আউলিয়ার আধ্যাত্মিক শিষ্য আমীর খসরু বিভিন্ন আয়াতকে সুর দিয়ে বানালেন কাওয়ালী। মনের আকাশে মেঘ আসলে সুফি আর কাউয়ালিই শক্ত মনের ফুটো ছাতাকে আগলে বাঁচিয়ে রাখে। তার জন্য AR Rahman এর প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচণ্ড ভালো মানের কাওয়ালী চর্চা হচ্ছে। এমনকি হিন্দুদের 'কুম্ভমেলা'তেও এ ধরনের গান করা হচ্ছে।

অনেকেই জেনে থাকবেন 'Rockstar(2011)' সিনেমার "Nadaan Parinde" গানের "Kaaga re kaaga re mori itni araj tose, Chun chun khaaiyo maans, Arajiya re khaaiyo na tu naina more, Piya ke milan ki aas" এবং 'নয়নের আলো(১৯৮৪)' সিনেমার, "আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না, আমি মরে গেলেও তারে দেখার সাধ মিটবে না গো, মিটবে না, তারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন"- এই দুটো গানের কথা প্রায় এক। কিন্তু আপনি জানেন কি দুটো গানের কথা প্রায় ১০০০ বছর আগে পাকিস্তানের মুলতানে খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাবের বংশধর বাবা শেখ ফরিদ নামে একজন সুফী সাধক লিখেছিলেন সূফী গান হিসেবে?

তার মূল লেখাটি ছিল-

"Kaaga karang Dhadoliya saglaa Khaaiyo Mass Aey,
Do Nainaan Mat Chhuchho pir dekhan ki aas"

এবার লোকগানের কথায় আসি, যা বাংলার সবচেয়ে প্রাচুর্যে ভরা কিন্তু নিগৃহীত সম্পদ। একবার ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক যার পূর্ব পুরুষ এ দেশের, শ্রদ্ধেয় দেবজ্যোতি মিশ্র কথা প্রসঙ্গে আমায় বাংলাদেশের লোকজ গান নিয়ে বলেছিলেন, গোটা আফ্রিকান উপমহাদেশের সকল লোক গানের ধরন এক করলেও বাংলার লোকগানের ভাণ্ডারের কাছাকাছি পৌঁছাবে না। প্রচলিতভাবেই পাওয়া যায় ১৫-২০ ধরণ। উপশাখা এবং এগুলোর বাইরে আছে আরো অনেক। বাংলা লোক গানের মত এতো সহজ করে সহজ ও কঠিন কথা আবেগ দিয়ে দেহতত্ত্ব, আধ্যাত্মবাদ, মানুষের সুখ-দুঃখ- আর কোনো গানে প্রকাশ করা সম্ভব কিনা জানা নেই।

ওদিকে Rock and Pop (বাংলা ও English) এর বিশাল একটি সাম্রাজ্য রয়ে গেল, যাতে দেরিতে এসে হলেও ডুব মারলাম। Elvis Presley, Beatles আর Queen হল, "I love you that much more than one can even think! দূরে যাস! ঠিক আছে! এই এই করলাম তোর জন্য। দূরে গেলে আমাকে ছাড়া থাকিস কেমনে! দেখে নেবো!" ধরনের। Mozart আর Beethoven শুধু সুরের মূর্ছনা দিয়ে কোথায় কোথায় নিয়ে যায়, সে ভাবাও যায় না। দিনশেষে সব শুনলে মনে হবে কোনো না কোনো ভাবে সবগুলো ধরণই একসাথে যুক্ত। একবার রবিঠাকুরের 'তোমায় গান শোনাবো'র সাথে Beethoven এর Bagatelle No. 25 in A minor(Für elise) মিলিয়ে শুনে দেখবেন। আলাদাই মনে হবে না। সংগীতময়তার প্রাচুর্যে প্রবলভাবে পরিচ্ছন্ন হয়ে মন ডুবে যাবে। খেয়াল, ধ্রুপদ, ঠুমরীর কথা আজ নাহয় নাই বললাম!

সাহিত্য ও সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করলেও দুটোর ময়নাতদন্তে আমার দখল একদম শূন্য। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের কেতাবি ফলাফল তারই উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তবে নানান জিনিস নানানভাবে দেখা বা অনুভবের এ তৃতীয় চক্ষু কীভাবে পেয়েছিলাম তা ঠাহর করাটা বেশ মুশকিল। লোকপ্রিয়তার চাইতে স্থায়ী ভালোবাসা এবং ভালো বাসা অনেক প্রয়োজন বলে যতবারই বিরক্ত-বিব্রত হয়ে প্রিয় এই সাহিত্য-সঙ্গীত থেকে সরে আসতে চেয়েছিলাম, ততবারই তার চাইতে দ্বিগুণ হারে নানান উছিলায় ঘাড়ে চেপে বসেছে আশীর্বাদ হয়ে। বুঝে গেছিলাম শব্দ, স্বর ও সুর থেকে বের হওয়া সম্ভব না। আমার মস্ত বড় এ কপালের লিখন।

পাদটিকাঃ 

০১।

Hooo meraa yaar hai rab vargaa
Dildaar hai rab vargaa
Ishq karun yaa karun ibaadat
Ishq karun yaa karun ibaadat
Ekko hi gal ai..

- My companion is like God. My lover is like God; whether I love or worship, Both are the same thing.

০২।

Kaaga re kaaga re mori itni araj tose, Chun chun khaaiyo maans, Arajiya re khaaiyo na tu naina more, Piya ke milan ki aas

- O Crow! I have just this request for You, Eat my meat selectively, Don't eat my eyes, please. I want to see my beloved with it in heaven".

০৩।

Kaaga karang Dhadoliya saglaa Khaaiyo Mass Aey Do Nainaan Mat Chhuchho pir dekhan ki aas

- O crow! Come and peck all this flesh over this skeletal frame of mine. Leave these two eyes untouched, for they are in wait of that Grand beloved of mine.

Comments

Popular posts from this blog

সুরের ভেলার ভেসে চলা - সঙ্গীতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ(ভারতীয় সঙ্গীত) : শুভ কর্মকার

সে এক কিশোরের গল্প - শুভ কর্মকার

আমার-আপনার বাঙালির রবি নজরুল... - শুভ কর্মকার