জন্মজয়ন্তীতে শ্রদ্ধার্ঘ, কবি...

খুব আদরের ছেলে বুলবুলের মৃত্যুর পরে নজরুল তখন কালী সাধনায় মনোনিবেশ করেছেন। গুরু হিসেবে গ্রহণ করলেন তাঁরই স্কুলের  শিক্ষক যোগীরাজ বরদাচরণ মজুমদারকে। অনায়াসে শত শত শ্যামা সংগীত নিমেষেই লিখে ফেললেন। এমন কিছু গান লিখলেন আর এমন সব সুর দিলেন, তাতে তত্ত্ব ও আবেগ দুটোই পরিমিত মেশানো। গোটা হিন্দু ধর্মীয় সঙ্গীত তো বটেই বাংলা গানের ইতিহাসে এমন কিছু আর হয়েছে কিনা সন্দেহ! মূলত নজরুল একটি পরিত্রাণ(Escape) খুঁজছিলেন। ছোটবেলা থেকেই এতো কষ্ট, এতো ট্রমা সহ্য করে এতদূর এসেছিলেন, তা বুলবুলের মৃত্যুতে আরও গাড় হয়ে গেছিল। নিতে পারছিলেন না কোনভাবেই।

ঠিক যখন পুত্রশোক কাটিয়ে উঠছিলেন, নজরুলের এই কীর্তিতে সমাজের একপক্ষ সন্তুষ্ট আরেক পক্ষ রুষ্ট। শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের অনুরোধে নজরুল সবে মাত্র ইসলামী সঙ্গীত লেখা শুরু করলেন। যথেষ্ট ঘোরাঘুরি পাগল ছিলেন তিঁনি। একদিন এক রেলস্টেশনে নামবার আগে কবি শুনলেন তাঁকে মারবার জন্য লাঠিসোঁটা নিয়ে জড় হয়েছে মানুষ। কারণ তিনি মুসলমান হয়েও শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন। কবি বিন্দুমাত্র উদগ্রীব হলেন না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বগি থেকে নামার সময় ইসলামী গজল গাইতে গাইতে নামলেন। দেখা গেল তাকে যারা মারতে এসেছিলেন সবাই লাঠিসোটা গুটিয়ে তার পেছনে অবাক হয়ে ইসলামী গান শুনতে শুনতে চলতে লাগলো। সেই ইসলামী গানগুলোয় খোদার প্রেমের নেশার  কথা আছে যাকে তিনি অদ্ভুতভাবে নিষিদ্ধ শারাবের কথা দিয়ে রূপক দিয়েছিলেন। বাংলা গানে গজল ঘরানার সাথে ধর্মীয় গানে এনে দিলেন নতুন দুটি ধারা। 

সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী এই কবিই ছিলেন পূর্ব বাংলার ১ম বাম-কেন্দ্রিক/কমিউনিস্ট রাজনৈতিক দলের সংগঠক। কিন্তু নির্বাচন লড়ে হেরে গেছিলেন, জামানত হারাতে হয়েছিল তাঁকে। বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে অস্ত্র চালনায় যেমন পারদর্শী ছিলেন, ক্যাম্পে বসে ফার্সি শেখা ও কলম চালনাতেও ছিলেন সুনিপুণ কৌশলী। আন্তর্জাতিক ও সাম্প্রতিক বিশ্ব নিয়ে এতটা জ্ঞান খুব কম মানুষই তৎকালীন সময়ে রাখতেন। আপনারা যে বলেন সৃজনশীলতার জন্য কষ্ট পেতে হয়, ভোগ করতে হয়, সত্যিই যদি জানতেন, যদি বুঝতেন এই কষ্টভোগ কতটা ভয়াবহ, কতটা মারাত্মক, তবে বলতেন কিনা সন্দেহ ! কবির ছোটবেলা কেটেছে বাবা-মা'য়ের আদর-শাসন ছাড়া, পড়েছেন ও গড়েছেন সম্পূর্ণ নিজ উদ্যমে নিজেকে। যৌবনে সৈয়দা খাতুনকে ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন নার্গিস, মন প্রাণ ঢেলে প্রেম করেছিলেন, কিন্তু হারিয়েছেন সব। সৃজনশীল মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকে অমর করে রেখে যায়। কবিও জীবন পথে যাদের ভালোবাসতে চেয়েছিলেন তাদের অমর করে রেখে গেছেন তাঁর গানে-লেখায়। হারাতে হারাতে একসময় হয়ে গেছিলেন স্তব্ধ-বাকরুদ্ধ। কলম আর সুর দুটোই একদিন দুম করে থেমে গেছিল। শেষে, মৃত্যুর আগে বিদেশের মাটিতে হারিয়েছিলেন বাঁচার শেষ অবলম্বন ও ভালোবাসা, স্ত্রী প্রমীলা দেবীকে, যিনি নিজে অসুস্থ হয়েও অসুস্থ কবিকে আগলে রেখেছিলেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। 

মাত্র ২২ বছরের সাহিত্য জীবন অনেক কম, অনেক কম, কবি! সাড়ে ৪ হাজার গানের সুর আর মানুষের বুক ভাঙ্গা না বলা আর্তনাদ এখনো আপনাকে ঘুরে ফিরে খুঁজে বেড়ায় বোঝানোর শব্দ খুঁজে পাবে বলে। আপনাকে অনেক বেশিই আগে হারিয়ে ফেলেছি। আর বাঙালি হিসেবে অপব্যবহার করে ফেলেছি অনেক বেশি না জেনে, না বুঝে। জন্মজয়ন্তীতে শ্রদ্ধার্ঘ, কবি। 🌻




Comments

Popular posts from this blog

সুরের ভেলার ভেসে চলা - সঙ্গীতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ(ভারতীয় সঙ্গীত) : শুভ কর্মকার

সে এক কিশোরের গল্প - শুভ কর্মকার

আমার-আপনার বাঙালির রবি নজরুল... - শুভ কর্মকার