ভাষার কথা

প্রত্যেক ভাষাই বহমান নদীর মত। বারবার ভেঙ্গে-গড়ে চলতে থাকে। বহু বিদেশি শব্দ যেমন 'শহিদ', 'মিনার', 'পুষ্প', 'একাডেমি' আর 'আরাম' ইত্যাদি বাংলা ভাষায় পারিভাষিক শব্দ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। সে হিসেবে উল্লেখিত সবগুলোই বাংলা শব্দ এবং শ্রেনীকরণে তারা পারিভাষিক। ফলিত ভাষাতত্ত্বের শিক্ষার্থী হিসেবে ইংরেজিতে পড়ার সুবাদে ইংরেজিতেও এরকম ভুড়ি ভুড়ি পরিভাষা পেয়েছি। যেমনঃ Abhisar (বাংলা), Adda(বাংলা), Dinghy(বাংলা), ballart(Australian), banana(African), chimpanzee(African), admiral(Arab), albatross,(Arab), Fest(German), Jungle(সংস্কৃত) ইত্যাদি। একটি লেখায় পড়েছিলাম বর্তমান ইংরেজি ভাষায় শতকরা ৪ ভাগ নিজস্ব শব্দ রয়েছে, বাকি সবই ধার করা(লিংক কমেন্টবক্সে। প্রয়োজনে যোগের অনুরোধ রইলো)। কমবেশ সব ভাষার ভান্ডারেই এমন শব্দ যুক্ত হয়। 'টেবিল-চেয়ার', 'আরাম', 'দলিল-দস্তাবেজ' অতীতে যেমন বাংলায় ঢুকে গেলো, কিংবা প্রযুক্তিগত শব্দগুলো বর্তমানে যেমন দরজায় দাঁড়িয়ে ঘরে আসি আসি করছে, ব্যাপারটা ঠিক তেমনি। কিন্তু 'কমফোর্ট ফিল' করাটা পারিভাষিক না। সেটা ইংরেজিই। 'কম্ফোর্ট' শব্দটির অর্থ শুধু 'আরাম' না, বাংলা শব্দভাণ্ডারে আরো আছে। আমরা 'কম্ফোর্ট' এর পরিবর্তে 'স্বস্তি', 'স্বাচ্ছন্দ্য' বা 'ভালো' শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারি। এসবে কথার জৌলুশ কমে তো না-ই, বরঞ্চ যে ভাষায় কথা বলছি তা শুদ্ধভাবে বলতে পারাটা বক্তার প্রতি আকর্ষণ বহুগুণে বাড়িয়ে ফেলে।

অবশ্য ভাষায় যেমন করে নতুন শব্দ যোগ হয়, রূপ বদলায়, বাংলায় যেমন করে ভিনদেশী ভাষাগুলো আস্তানা গেঁড়ে স্বদেশী হয়ে গেছে, দেখা যাক ততদিনে ইংরেজির এসব দু চারটা শব্দ ঢুকেও বাংলার রুপ নেয় কীনা। তবে এরকম দৃষ্টিকটু সংযোজনে উপকার যা হবে তার চাইতে ভাষা এবং সর্বোপরি সাহিত্য, সংস্কৃতিতেও ধীরে ধীরে ভিনদেশী ভাষার সার্থক উপনিবেশবাদ রূপায়ন হয় বলে মনে করি। ঠিক যেমন করে অনেক লেখকই আমরা অনেকেই নিজ মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে নিজের আপন বাংলা ভাষার শব্দই হারিয়ে ফেলছি, যা নিজেদের অজান্তেই আমাদের উপনিবেশিক মনস্তাত্ত্বিকতার সুন্দর একটি প্রামাণ্য উদাহরণ।

অথচ ভিনদেশী ভাষার ক্ষেত্রে এই বিপরীত আচরণ প্রশ্রয় দেয়াটা কিন্তু আমরা মোটেই সহ্য করতে পারি না। এমনকি অস্ট্রেলিয়ান ইংলিশ, আফ্রিকান ইংলিশ, বৃটিশ ইংলিশ এবং নব্য ভারতীয় ইংলিশ নামে ইংরেজি বলার নানান ধরন প্রতিষ্ঠিত থাকলেও বাঙালির সামান্য বাংলা টানের ইংরেজি বলার প্রকৃতি মোটেও গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেয়া হয় না।

বাংলা এমন এক মায়ের কোল যা স্বদেশী-বিদেশী বা অতিথি সবাইকে আশ্রয় দিয়েছে পরম স্নেহে, শিখিয়েছে অন্যের ভাষা ও সংস্কৃতিকেও সম্মান দেখানোর শিক্ষা। আর তাই বাংলা আজ পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। ২১ এমন একটি সংখ্যা যার সার্থকতা শুধু মায়ের ভাষায় মনের ভাব বলবার অধিকার আদায়ের জন্য কিছু টগবগে যুবকের তাজা রক্ত ঝরানোয় এবং প্রতি বছর ভাষার মাস উদযাপনে এসে পড়ে নি। যারা সেদিন রক্ত দিয়েছিলেন তাদের উত্তরসূরি হিসেবে নিজ ভাষার প্রতি নিজেদের মূল্যায়নের উপরেও বর্তায়। কিন্তু বাঙালির মত স্ববিরোধী কাক-পটি-গত বিব্রতকর আচরণ আর কেউ কখনো করেন কীনা জানি না। রক্ত দিয়ে ৫২ তে বাংলা পেলাম, ৭১ এ দেশ। আর সে বাংলাদেশের আদালত ও উচ্চ শিক্ষায় রাষ্ট্রভাষার প্রচলন নিশ্চিত করতে পারাটা এখনো বাকি। শব্দ, ভাষা বা আয়োজন, মূল্যায়ন নিয়ে আমরা যেভাবে যাচ্ছেতাই করে আসছি তা অনাচার-ব্যভিচার ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।

"‘নানান দেশের নানান ভাষা।

বিনে স্বদেশীয় ভাষা,

পুরে কি আশা?"

 



Comments

Popular posts from this blog

সুরের ভেলার ভেসে চলা - সঙ্গীতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ(ভারতীয় সঙ্গীত) : শুভ কর্মকার

সে এক কিশোরের গল্প - শুভ কর্মকার

আমার-আপনার বাঙালির রবি নজরুল... - শুভ কর্মকার