মন্দিরের মূলের খোঁজে…

'মন' আর 'ধীর', শব্দ দুটো মিলে হয়ে গেলো 'মন্দির'। মূলত সৃষ্টির আদি থেকেই মন্দির শব্দটির মাহাত্ম্য এমনই ছিল। যেখানে কোনো অবয়বও থাকবে না। নিরাকার ও কল্পনার অতীত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টাকে মনে করে মানুষ তার মনের অস্থিরতা দূর করবে। প্রতিমাগুলো ছিল ঋষি কল্পনায় পাওয়া যন্ত্র মাত্র, আর কিছু না৷ মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়া আশ্রম ও শিক্ষালয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, বোধ ও বিবেকের সাধনা হত। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র থেকে শুরু করে কূটনীতি, অর্থ বা অস্ত্র শাস্ত্রের উদ্ভব এসব মন্দিরভিত্তিক আশ্রমেই হয়েছে। আর্য সমাজ ব্যবস্থায় “সনাতন” ধর্ম নামে যখন কিছু সৃষ্টি হয় নি তার আগ থেকেই জ্ঞান সাধনার এ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল যা পরবর্তীতে বৌদ্ধ সমাজ ও জীবন ব্যবস্থায় সংযুক্ত হয়েছিল। যার ফলে জ্ঞান সাধনার এক উচ্চমার্গীয় সংমিশ্রণ ঘটতো প্রাচীন মন্দিরগুলোতে। 
 
দর্শন, পুরান, ইতিহাস, প্রকৌশলবিদ্যা সহ সকল শাস্ত্রের মিলন ঘটতো মন্দিরগুলোর শরীরে। কিছু মন্দিরের ইতিহাস তো এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি কেউ। ভারতের মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলায় প্রসিদ্ধি ইলোরা গুহার মধ্যে অবস্থিত কৈলাস মন্দির। কেউ কেউ বলে থাকেন এই মন্দিরটি ভিনগ্রহের প্রাণীদের দ্বারা তৈরি কিন্তু এটি আজো অনেক বড় রহস্য। মন্দিরটি আওরঙ্গজেব পর্যন্ত  তার হাজার সেনাবাহিনী দিয়ে ধ্বংস করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে যান। আরেকটি মন্দিরের কথা মাথায় আসছে যেটি উত্তর প্রদেশের কানপুর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি প্রাচীণ বিষ্ণু মন্দির। জনশ্রুতি প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো এই মন্দিরের রহস্যটি হল বর্ষা আসার ৫ থেকে ৭ দিন আগে থেকেই এই মন্দিরের ছাদ চুঁইয়ে মন্দিরের ভেতরে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে থাকে। সারা বছরে আর কখনোই এমনটা হতে দেখা যায় না। খুব জটিল বা অলৌকিক মনে হলেও আসলে খুবই সহজ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এতে। মন্দিরটি তৈরি হয়েছে চুনাপাথর ব্যবহার করে। ফলে বৃষ্টির আগে থেকেই আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, চুনটি বায়ুমণ্ডল থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে। এই আর্দ্রতা পাথর পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং পাথর থেকে জল ফোঁটা ফোঁটা শুরু করে। যখনই বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায় তখন বৃষ্টি হয়।
 
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আগে মন্দির তৈরিত প্রযুক্তির সমাহার মানুষের কাছে নানান বার্তা পৌঁছানোর রক্ষাকবচ উপায় হিসেবে হলেও এখনকার মন্দির-আশ্রমগুলোর দেব প্রতিমা নানান দামি পাথরের উপরে সোনায় মোড়া আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, দেবতাকে রক্ষা করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে বড় বড় প্রতিমা-স্থাপনা গড়ার প্রতিযোগীতা চলে নিয়মিত, কে কত বড় উৎসব-অনুষ্ঠান করতে পারছে তার অসুস্থ প্রদর্শন, দান-দক্ষিণার বিচারে ভক্তদের সম্মান দেয়া, ধর্মের বিচারে একটু জল খাওয়ানো নিয়ে মানুষকে আলাদা ভাবা, আর হাজার বছর ধরে একই শোষণের গল্পের পুনরাবৃত্তি হয় প্রতিদিন। অথচ দেবতাকে রক্ষা করবে মানুষ? ধর্মকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করবে মানুষ? এতো ক্ষমতা মানুষের?  কিন্তু দেবতা নাকি সব দেখেন ! সব জানেন ! সব বোঝেন ! হায় দেবতা ! হায় !


সকল শাস্ত্রের সব কথার শেষ কথা এসে ঠেকছে নিজেকে জানার চাইতে পবিত্র আর কোন পাওয়া হতে পারে না। যে শাস্ত্র পূজা করা হয় তা মানুষেরই সাধনালব্ধ জ্ঞান। বই বা শাস্ত্র তাই পূজার চাইতে খুলে পাঠোদ্ধার করা বিশাল পূণ্যের কাজ।
 গীতায় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন, “ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে(৪/৩৮)। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, “Know thyself” অর্থাৎ নিজেকে জানো। বিশ্বাস করি মন্দির হবে অশান্ত মন ধীর করার মত, শান্ত করার মত, নিজেকে জানা ও বোঝার বার্তাবাহক। চাকচিক্য আর বাহুল্যবর্জিত।


লেখকঃ শুভ কর্মকার
ত্রৈমাসিক তপোবনের কয়েকটি কথা-তে প্রকাশের জন্য লিখিত।(আংশিক পরিমার্জিত)


ELLORA CAVES – KAILASH TEMPLE & CAVE WORLD HERITAGE SITE


Comments

Popular posts from this blog

সুরের ভেলার ভেসে চলা - সঙ্গীতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ(ভারতীয় সঙ্গীত) : শুভ কর্মকার

সে এক কিশোরের গল্প - শুভ কর্মকার

আমার-আপনার বাঙালির রবি নজরুল... - শুভ কর্মকার