পুজোর পাঁচালি

ছোটবেলা প্রায় কিলোমিটার আন্দাজ পথ হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হত। বছরে যতগুলো বড় বড় ছুটি পেতাম, তাঁর মধ্যে গ্রীষ্ম ও পুজোর ছুটি দুটো ছিল খুব প্রত্যাশিত। পূজোর ছুটি দেবার দেড় দু-মাস আগ থেকেই সারা শহরতলি জুড়ে পুজোর আঁচ পেতাম। কুমোরপাড়ার শিল্পীরা থাকতেন লক্ষ্মী প্রতিমা গড়া নিয়ে ব্যস্ত আর দেশী-বিদেশী কারিগররা মন্দিরে মন্দিরে গড়তেন সুনিপুণ দুর্গা প্রতিমা। এ দু মাস সময় স্কুল থেকে বাসা ফেরার পথে একবার হলেও ঢুঁ মেরে দেখে যেতাম জগন্নাথ আখড়ার প্রতিমা। কারিগর পর্দা দিয়ে ঢেকে লোকচক্ষুর অগোচরে কাজ করতেন। অত নিষেধ আপত্তি তোয়াক্কা না করেই হিন্দু মুসলিম সব বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে দেখে নিতাম কাঁচা মাটিতে গড়া প্রতিমাগুলোকে।

স্কুলের শিক্ষিকাদেরকে আফা/দিদিমণি ডাকতাম। ক্লাসে যেদিন তারা পূজোর ছুটির কথা বলে যেতেন সেদিন থেকেই পুজোর আনন্দ শুরু হয়ে যেত আমাদের। পঞ্চমী না ষষ্টি, ধারা ধারির কোন বালাই ছিল না। কম্পিটিশন চলত কোন মন্দিরের প্রতিমা সবচে মনকাড়া। জাঁকজমকতা দেখে নির্ধারণ করে ফেলতাম ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড। আড়ম্ভরতা না থাকলেও দল বেঁধে পূজা মণ্ডপ ঘুরতে ঘুরতেই চলে যেত ষষ্টি-সপ্তমী।

দুর্গা পূজার অষ্টমী-নবমীতে থাকত বিশেষ আয়োজন। আরতি নৃত্য, গান, শঙ্খ-উলুধ্বনি বাজানো, কুইজসহ নানা রকম প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে কেটে যেত সন্ধ্যাগুলো। ছেলেপেলেরা হাজারো লোভনীয় পুরস্কারের আশায় অংশগ্রহণ করত প্রতিযোগিতায়। মাঝে মাঝে প্রতিযোগীদের চাপে পারফর্ম করার সুযোগটুকুও পেত না তারা। চড়া দামে ঠিক করা দেশ বিদেশী ঢাকিরা ঢাক বাজাতেন মন্দিরে। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লান্ত না হতেন, চলত ঢাকের বাদ্যি। রাত ২/৩টা পর্যন্ত পুরো তল্লাট থাকত হরেক রকম বাজির কান-ফাটানো শব্দে মুখরিত। বাজিগুলো (স্থানীয় ভাষায়ঃ গম, মরিচ, ককটেল বাজি(পেট্রোল ককটেল না), ঝিলিক, ক্যারা, নাটিম ইত্যাদি) এমনভাবে ফোটানো হত যে পরদিন সকাল ঘুম থেকে উঠে হিন্দু পাড়াগুলোতে বাজির আবর্জনায় হাঁটাটাই হয়ে যেত কষ্টকর ।

পূজার দশমী ও শেষের দিনে বই-পুস্তক নিয়ে প্রতিমার পা ছুঁয়ে সবাই যে যার মত করে মা’য়ের কাছে প্রার্থনা জানাতাম। বড়রা প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি নিতেন শহরের পাশে বয়ে যাওয়া ডাকাতিয়া নদীতে । ১৩-১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেপেলেরা কখনই প্রতিমা বিসর্জনে যেতে পারত না। ভিড়, কোলাহল, বাজি ফুটানোর হিড়িক, উন্মাদনা এত ভীষণ থাকত যে পিষে মরে যাবার ভয়ে ছোটরা সামনে এগুনোর সাহসটুকু পর্যন্ত পেত না। মা’কে তেল-সিঁদুর পরিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেখবার জন্য ঘরের বউ ঝিয়েরা বাচ্চাদের সাথে নিয়ে উঠে যেতেন তসিল অফিসের ভাঙ্গা দালানের ছাদে। পুরো রায়পুর শহর ঢাক ও বাজি ফুটানোর শব্দ আর লাল-নীল রঙের আস্তরণে ছেয়ে যেত। তীব্রতা এত বেশি থাকত যে প্রতিমা বিসর্জন কোথায় হয়েছিল এবং কারা ছিলেন তা দশমীর ৫-৭দিন পর হলেও দুটোই চেনা যেত গায়ের রঙ দেখে। সেদিন আমাদের সে রাস্তায় বের হওয়া ছিল একদম বারণ। রাত ৮টার আগে বিসর্জনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়াটা বেমানান দেখাত। পাড়া-মহল্লার কিশোর-তরুণ বয়সী স্বজনদের উন্মাদনার কাছে ছিলাম অসহায়। আফসোস হত কবে বড় হব! দুর্গা মায়ের কাছে প্রার্থনা থাকত যাতে তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাই, আর সব উপভোগ করতে পারি ।

দিন পাল্টেছে। বদলেছে প্রজন্ম, প্রেক্ষাপট, সামাজিক অবস্থান। আগের প্রতিমা কারিগর এখন কম আছেন যাদের দীর্ঘ দেড়-দুমাস ধরে গড়া দেবী প্রতিমা দেখলে মানুষের ভাব-ভক্তি আসে। কিছু কিছু মণ্ডপে গেলে তো বিকৃত রুচিহীন রেডিমেড প্রতিমা দেখে লজ্জায় পড়ে যাই আজকাল। সেই ঢাকিরাও নেই যারা দিনরাত টানা ঢাক বাজাতে পারেন। এসেছে সাউন্ড সিস্টেম, ডীজে। এখন মাঝে মাঝে মন্দিরে গেলে শুনি ‘শিলা কি জওয়ানি/লুঙ্গি ড্যান্স’ টাইপের হিন্দি আইটেম সং। নিরাপত্তার অজুহাতে বাজি ফোটানো পুরোপুরি বন্ধ। সন্ধ্যার প্রাণবন্ত কম্পিটিশনগুলোও নেই আগের মত, কিন্তু নেশার আড্ডা ঠিকই চোখে পড়ে নিয়মিত। দশমীর বিসর্জনে পাই না সেই আগের উন্মাদনা। ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে তসিল অফিসের পুরোনো দালানটি।
দুম করে কেমন যেন সব মিলিয়ে গেল !
আজ খুব মিস করি তখনকার সে ছোট্ট “আমি”কে!
© October, 2016

Comments

Popular posts from this blog

সুরের ভেলার ভেসে চলা - সঙ্গীতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ(ভারতীয় সঙ্গীত) : শুভ কর্মকার

সে এক কিশোরের গল্প - শুভ কর্মকার

আমার-আপনার বাঙালির রবি নজরুল... - শুভ কর্মকার