ইশকুলের ঘুলঘুলি : The loop-hole of GPS Education.

দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ব্যবস্থার কতটা উন্নতি হয়েছে তা যারা বর্তমানে শিক্ষক হিসেবে স্কুলগুলোতে আছেন কিংবা সংশ্লিষ্ট আছেন তারা নিশ্চই ভালো করে জানেন। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমার সময়ে যদি আমি এখনকার সরকারি প্রাথমিক স্কুল এবং কিছু শিক্ষক পেতাম তবে আজকে হয়ত অনেক ভালো অবস্থায় থাকতাম। দেশের বর্তমান সরকার এবং শিক্ষাখাতের নীতি নির্ধারকরা এসবের জন্য অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। বাজেট থেকে শুরু করে সার্বিক পদক্ষেপগুলো দারুণভাবে প্রশংসনীয়।

দেশের সবচেয়ে নির্ভেজাল শিক্ষিত লোকদের কর্মক্ষেত্র এবং সুবিধাভোগীদের সেবা গ্রহণের ক্ষেত্র এটি। শিক্ষকদের নিয়মিত সকালে ঘুম থেকে উঠে উদ্দেশ্য একটাই থাকে স্কুলে গিয়ে ফুলের মত শিশুদেরকে শিক্ষা দেয়া। শিক্ষকরা নিজেদের উপরে ন্যস্ত দায়িত্বভার সুসম্পন্ন করার মানসিকতা নিয়েই আসেন স্কুলে। কিন্তু, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাদান এবং সহপাঠ্য শিক্ষার পাশাপাশি আর কী কী হচ্ছে? দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করার প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি বা করছি।

আপনি যদি সংশ্লিষ্ট থাকেন প্রতি সপ্তাহে গিয়ে দেখবেন নতুন কর্মসূচি, নতুন কনসেপ্ট। কিছু কিছু নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু সে ভালো যদি গ্রামের স্কুল আর শহরের স্কুল অনুযায়ী তারতম্য ঘটায় তবে স্কুলভিত্তিক বা অঞ্চল ভিত্তিক কর্মসূচি কেন নয়? ঢাকার স্কুলে যা কার্যকরী সেটা মহেশখালীর জেলেপাড়ার কোন স্কুলে নাও হতে পারে। যেখানে বাচ্চাদের আগে বর্ণ শেখা জরুরি, শব্দটা পরে, সেখানে "উপর" থেকে "অর্ডার" এসেছে বলে কেনইবা একদিনে একশব্দ শেখাটা বাধ্য করাই লাগবে? এসব নিয়ে "উপরে"র কারো ভাবনা দেখি না। 'সৃজনশীল পদ্ধতি'র কথাই ধরি। খুব ভালো লাগে যখন দেখি বাচ্চারা নিজের মত করে ভাবতে পারছে। আবার ঠিক উল্টো অনুভূতি হয় যখন দেখি সৃজনশীল উত্তরও তারা বাধ্য হয়ে মুখস্ত করছে ভালো ফলাফলের জন্য। এখন কথা আসতেই পারে, শিক্ষক তবে কী করেন?

শিক্ষা উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সপ্তাহ পর পর আসে নতুন নতুন প্রজ্ঞাপন। তার উপর কিছু ফর্মালিটি তো আছেই, যা বিনে পয়সায় খাটিয়ে নিয়ে করা হয়। যেমনঃ ভোটার হালনাগাদ, স্কুলে নানান নির্বাচন, জরিপ, বৃত্তি, উপবৃত্তির কাজ, ফলাফলের কাজ, লেখাজোখার কাজ, উপরমহলের বাসায় "কাঁঠাল পাঠানো", যোগাযোগ রাখা, গার্জিয়ান মিটিং, বাচ্চাদের ওজন-উচ্চতা মাপা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে নানান ফর্মালিটি তো আছেই। এসবের ভীড়ে পড়াশোনা কিংবা নৈতিকতা শেখানোর যে প্রধান উদ্দেশ্য থাকে সেটাই হয়ে উঠে না। শিক্ষকের মত একটি পেশাকে স্বাধীনতা না দেয়া হলে, তিনি স্বাধীনভাবে ভাববেন কি করে, সৃজনশীলইবা হবেন কী করে ! নিয়ম অন্ধভাবে মানতে মানতে নিয়ম কেন করা হয়েছে সে ফলাফল বাস্তবায়নের কথাই ভুলে যাই, নিয়মটাই থেকে যায়। স্কুল বন্ধ থাকলেও এসে কিংবা ক্লাস শেষে এই গোবেচারা শিক্ষকদেরকেই কাজগুলো করতে হবে। বাংলাদেশে ভার্সিটির গ্র‍্যাজুয়েট প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতায় আসছেন/থাকছেন বলতে পারবেন? কিংবা উৎসাহিত করা হচ্ছে কি? দেশের নিষ্পেষিত কর্মক্ষত্রের মধ্যে সরকারী স্কুলগুলো অন্যতম। দেশের যত নিয়ম কানুন সব মানা লাগে এই প্রাইমারি স্কুলে। কিছুদিন আগে প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়েছে, প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের দিয়ে ফুলের টব, বদনা, কমোড, স্কুলের আশেপাশের জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে বাচ্চাগুলোকে যদি জমে থাকা পানি-ঝোপঝাড়ের এডিস মশা কামড়ায়। এরপরে যদি তাদের ডেঙ্গু হয়, তাহলে তার দায় কে নেবে? বাচ্চারা তাদের শেখার অংশ হিসেবে স্কুল নিয়মিত পরিষ্কার করছে বা রাখছে, ততটুকুই তো যথেষ্ট। এসব বিপদজনক কাজ তো শহর হলে সিটি কর্পোরেশন, গ্রাম হলে ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদের করার কথা।

নিয়মের নামে দিয়ে করা নানান অবিচার এবং দুর্নীতি দমনের নামে অনেক অনাচারের খড়গ সরকারী এই প্রাইমারি স্কুলগুলিতেই পড়ে। চুনোপুঁটিদের পত্রিকায় হেডলাইনে এনে রাঘববোয়ালদের সরিয়ে দেয়া হয়। আইওয়াশ করা হয় শিক্ষকদের বলির পাঠা বানিয়ে। আপনি শিক্ষক হিসেবে ঢুকেছেন তো দিনের আলোর বাকি সব কাজ ভুলে যেতে হবে। অনেক স্কুলেই সকাল ৯-৫টা বিনা বিরতিতে শিক্ষকদের টানা ক্লাস নিতে হয়। আপনার বাসা যদি স্কুলের পাশের ঘরটিতেও হয়, টিফিনে যাওয়া বারণ। কারণ ভয় ! পাছে সচিব আসে ! এসে না পায় ! কথাগুলো হাস্যকর। কিন্তু দুদক গ্রামের প্রাইমারি স্কুল চেনে, শহরের রাজউক চেনে না। ঝড়, বৃষ্টি, জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড় যাই হোক ! দায়িত্বশীলের কথা; আসতেই হবে, নইলে Leave কাউন্ট হবে। স্কুলের দপ্তরী, কেরানী কিংবা হিসাবরক্ষক সকল কাজ শিক্ষককে করতে হলেও মাসশেষে পকেটে আসবে প্রজাতন্ত্রের ১১ গ্রেডের সম্মানী। শেষমেশ, এসব বাড়তি কাজের জন্য পড়াশোনা কিংবা নৈতিকতা শেখানোর যে উদ্দেশ্য থাকে সেটাই সফল হয় না, নিজের জন্য পড়া তো অনেক পরের কথা। অবশেষে একদিন শিক্ষকও বুঝে যান, তিনি এখন "সিস্টেম" হয়ে যাচ্ছেন/গেছেন।

নিয়মের নামে দিয়ে করা নানান অবিচার এবং দুর্নীতি দমনের নামে অনেক অনাচারের খড়গ সরকারী এই প্রাইমারি স্কুলগুলিতেই পড়ে। চুনোপুঁটিদের পত্রিকায় হেডলাইনে এনে রাঘববোয়ালদের সরিয়ে দেয়া হয়। আইওয়াশ করা হয় শিক্ষকদের বলির পাঠা বানিয়ে। আপনি শিক্ষক হিসেবে ঢুকেছেন তো দিনের আলোর বাকি সব কাজ ভুলে যেতে হবে। অনেক স্কুলেই সকাল ৯-৫টা বিনা বিরতিতে শিক্ষকদের টানা ক্লাস নিতে হয়। আপনার বাসা যদি স্কুলের পাশের ঘরটিতেও হয়, টিফিনে যাওয়া বারণ। কারণ ভয় ! পাছে সচিব আসে ! এসে না পায় ! কথাগুলো হাস্যকর। কিন্তু দুদক গ্রামের প্রাইমারি স্কুল চেনে, শহরের রাজউক চেনে না। ঝড়, বৃষ্টি, জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড় যাই হোক ! দায়িত্বশীলের কথা; আসতেই হবে, নইলে Leave কাউন্ট হবে। স্কুলের দপ্তরী, কেরানী কিংবা হিসাবরক্ষক সকল কাজ শিক্ষককে করতে হলেও মাসশেষে পকেটে আসবে প্রজাতন্ত্রের ১১ গ্রেডের সম্মানী। শেষমেশ, এসব বাড়তি কাজের জন্য পড়াশোনা কিংবা নৈতিকতা শেখানোর যে উদ্দেশ্য থাকে সেটাই সফল হয় না, নিজের জন্য পড়া তো অনেক পরের কথা। অবশেষে একদিন শিক্ষকও বুঝে যান, তিনি এখন "সিস্টেম" হয়ে যাচ্ছেন/গেছেন।




বিদ্যালয়ের আশেপাশ পরিষ্কারে ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা
প্রজ্ঞাপন

Comments

Popular posts from this blog

সুরের ভেলার ভেসে চলা - সঙ্গীতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ(ভারতীয় সঙ্গীত) : শুভ কর্মকার

সে এক কিশোরের গল্প - শুভ কর্মকার

আমার-আপনার বাঙালির রবি নজরুল... - শুভ কর্মকার