বেশ ভালো আছে আদি !
আদিত্য, ছোট নাম 'আদি'। বরাবরই খুব সুখী একজন মানুষ।
কোনটা জীবনের অংশ তা বেছে নিয়ে চলতে শিখে গিয়েছিল অনেক আগে। সুখটা কী তা জানতো। কিন্তু তবুও এই কিছুদিন আগেই জীবনের খুব বাজে একটা সময়
পার করে এসেছে! এতটা খারাপ মেন্টাল কন্ডিশন নিজের বয়োঃসন্ধিকালেও ফেস করেছে বলে মনে
পড়ে না। নিজেকে
মেন্টালি সাপোর্ট দেয়ার জন্য একমাত্র নিজেই সবসময় ছিল। ছোটবেলা থেকেই নিজে নিজে সব
সামাল দিয়ে সাধ্যমতো ব্যালেন্স করে চলার অভ্যাস। অনেকটা সেল্ফ-মোটিভেটেড যাকে বলে।
একলা বদ্ধ ঘরে তুলসীর একটি চারা, খোলা জানালার ফাঁকে এক
চিলতে আকাশ, মেঘ, আর দু চারটা
গান। মাঝেমধ্যে দূরে থাকা পরিবার আর গুণে গুনে তিনজন বন্ধু ও সিনিয়রের দূর থেকে
দেয়া অনুপ্রেরণা ছাড়া কিচ্ছু ছিল না ওর। একদম শূণ্য! দু-চারবার সাইকোলজিস্টের দুয়ারে
গিয়েছিল। সেখানেও গিয়ে বুঝলো, The one & only person who can heal himself is none but He, হয়ত ও সবার চাইতে একটু আলাদা।
অদ্ভুত হচ্ছে ডিপ্রেশনে থাকলে কেউই কখনো হেল্প চাইতে চায় না কারো কাছে। তাই "খারাপ লাগলে ফোন দিও" একথাটা পুরোই ইউজলেস। তাই কেউ যদি বলে, এসব হবে ভুয়া, ফর্মালিটি। কিন্তু আদিত্য যে ফোন দেয়নি তা না! কাউকে ফোনে পেয়েছি, কাউকে পায়নি। এখনো হয়ত অনেকের ইনবক্সে আনরিড হয়ে আছে ওর দেয়া মেসেজগুলো। বুঝলো ব্যস্ততাই বাস্তবতা ! বাকি সব ফিকে।
মনে আছে, একবার হতাশায় পড়ে দীর্ঘদিনের প্রিয় এক শিক্ষককে ফোন
দিয়েছিল। শ্রদ্ধেয়জনের শিক্ষকত্বসুলভ প্রফেশনালিজমটাই সেদিন কানে বেশি লেগেছিল। তার চেয়ে টেলিটক কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে আমার
আন্তরিকতা পাওয়া অনেক ভালো ছিল বলে বোধ করে আদি। এখন আনমনে ভাবে আর অবাক হয় ! হতাশার বশে এমন
অবস্থায় পড়েছিল যে তখনকার মানসিক বাজে পরিস্থিতিই নিজের নির্মল মনটাকে সব নিজের
ভুল বলে প্রবোধ দিয়ে বিষয়ে তুলতো ওর। সব সিচ্যুয়েশানই নিজের দোষের ফল লাগতো। সব
কর্মফল-পাপের কারসাজি মনে হত। অথচ খেয়াল করতে আদিত্যর বেশ সময় লেগেছিল যে ভুল বা
হতাশাগুলো এক একটি বৃত্তের ছোট ছোট বিন্দু। একবার একটি বিন্দু চলা শুরু করলে তা ঘুরে
ঘুরে পরিধি বাড়াতেই থাকে।
শেষটা থাকে ভয়াবহ। বিনয়বশত একজনের কাছে একবার "ভুলে"র ক্ষমা চেয়ে
দেখেছিল। বিনয়ের কদর তো নেইই, সম্মান উল্টো কমে যায়।
সে সময় আদির মনে হত, ধ্বংস হয়ে যাওয়ার এক পৃথিবীর একমাত্র জীবিত প্রাণ সে। একটুও অক্সিজেন
নেই বাঁচার জন্য। এক অন্ধকার কুয়োয় আটকে গেছে। তোলার কেউ নেই। কারো ক্ষমতাও নেই।
বসে আছে বাঁচবো বলে। আবার কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সবাইকে ভ্যাম্পায়ার ! রক্তপিপাসু ! ভয় লাগে। সব সম্পর্কগুলোকেই ব্যবহারের হাতিয়ার লাগতো ওর। কিন্তু এর
মাঝে কেউ যে অনুভূতিগুলো ভাগাভাগি করতে আসেনি তা না! দিনশেষে সবাই এক একটা
অভিজ্ঞতা হয়ে থেকে যায়। আর অভিজ্ঞতাগুলো হল এক একটি শিক্ষা। স্মৃতি ভালো-খারাপ
কিংবা মধুর-তিক্ত হয়। শিক্ষা কখনো খারাপ-ভালো হয় না, দরকারী
হয়। খারাপ-ভালো বিচারে তা আর শিক্ষা রয়না।
সবার সাথে কথা বলা একদম কমিয়ে
দিয়েছিল। বাসায়ও কম কথা বলত। মাঝেমাঝে ফোন এড়িয়ে চলত; পাশের রুমে থাকা ফ্ল্যাটমেট সাইফকেও। ভালো লাগতো না কিছু। মাঝেমধ্যে মেসেঞ্জারে
অনলাইন এসে পরষ্পরকে চিনি কিন্তু পরিচয় না হওয়া কয়েকজন ভালো মনে হওয়া
ব্যক্তিত্বের সাথে আলাপ করত। মনে হত, "হয়ত মরে যাব তাড়াতাড়ি, তাই সব গুছিয়ে ফেলি"। অন্তত অপরিচিত মানুষজন প্রথম পরিচয়ে আন্তরিকতা
প্রকাশ করে। প্রায়োরিটি দেয়। আর তাছাড়া যার সাথে এটাচমেন্ট নেই, তার কাছে হারানোর কিছু নাই। এই ধারণাই ওর মনে ছিল।
কখনই কান্না পেত না। মাঝে একরাতে থাকতে না পেরে সাবেককে ফোন দিয়েছিল। কথা বলার একপর্যায়ে আর ধরে রাখতে পারেনি। কয়েকদিন আগে ডাক্তারের কাছে গিয়ে শুনলো, কান্না করা দরকার ওর। চোখের কর্ণিয়ার পানি নাকি শুকিয়ে গেছে। প্রতি রাতে ভাবতো, ভালো কিছু হবে। অফুরান ভালো কিছু আসবে ওর জন্য। বিগত ডিপ্রেশনগুলো শেষ হবার পরে খুব ভালো কিছু এসেছিল উপহার হয়ে আদিত্যর জীবনে। খারাপ সময় কেটে যাবে, এই বলে বলে নিজেকে সামলাতো।
কখনই কান্না পেত না। মাঝে একরাতে থাকতে না পেরে সাবেককে ফোন দিয়েছিল। কথা বলার একপর্যায়ে আর ধরে রাখতে পারেনি। কয়েকদিন আগে ডাক্তারের কাছে গিয়ে শুনলো, কান্না করা দরকার ওর। চোখের কর্ণিয়ার পানি নাকি শুকিয়ে গেছে। প্রতি রাতে ভাবতো, ভালো কিছু হবে। অফুরান ভালো কিছু আসবে ওর জন্য। বিগত ডিপ্রেশনগুলো শেষ হবার পরে খুব ভালো কিছু এসেছিল উপহার হয়ে আদিত্যর জীবনে। খারাপ সময় কেটে যাবে, এই বলে বলে নিজেকে সামলাতো।
ছেলেটি কোন শখের বশে ডিপ্রেশনে যায় নি। এমন ছিল না কখনই। বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা থাকা অবস্থায়
সারাদিন খুব চিল থাকতো। গান,
পড়াশোনা, অনুষ্ঠান, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা-ঘোরাঘুরি সংগঠন নিয়ে।
সাজানো লাইফ-ক্যারিয়ার প্ল্যান, ঢাকা আর প্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে
এসেছিল এ ২ বছরে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য। চট্টগ্রামে আসাটা খুব স্বল্প সময়
হলেও এখানে এসে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষতো বারবার। আর মনে হত, না পাওয়াটা অনেক বেশি। তখন নিজেকে বিষণ্ণ লাগতো আরো বেশি। অতীতে সম্মান
করা এবং ভালোলাগার কিছু মানুষের পেছনে দেয়া সময়, শ্রম আর
অনুভূতিগুলোর কথা মনে আসলে কোন কাজই মন দিয়ে করা যেত না। ওর ডিজার্ভ করা জিনিস
কেন ও নিতে পারছি না ভাবতেই খারাপ লাগাটা বেড়ে যেত বহুগুণ।
খুব আপনজন যেখানে ফেলে চলে
এসেছিল সেখানে আদিত্য সো কল্ড অনেক
আপনজনদের কেমন আছে, কীভাবে আছে, কি
নিয়ে বাঁচে- খোঁজ নেয়া দরকারটা মাথায় নেয় নি। ইনফ্যাক্ট আসেও নি। যেভাবে বাঁচার
স্বপ্ন দেখে চট্টগ্রামে নিজেকে প্রস্তুত করতে এসেছিল, মাঝপথে
এসে দেখে সে-ই নেই। কাছের মানুষজন
আর সম্পর্কগুলোকে প্রায়োরিটি দিতে অভ্যস্ত সবসময়। শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন
দেখার অভ্যাস ছিলনা কখনো! পাছে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে আর সব ডিপ্রেশনে
থাকা মানুষগুলোর মত ভালো না লাগাটা প্রতিদিনকার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল। তখন জোর করে
ভালো থাকতো। সন্ধ্যা হলে বেড়িয়ে পরতো একা একা। হেঁটে বেড়াতো যদ্দুর হাঁটতে
চাইতো মন। একলা সে রাতগুলোয় যতই আশ্বাসে ভরা আবেদন আসুক না কেন, যে শূন্যতা গ্রাস করে ফেলছিল সবটুকু জুড়ে তার কাছে সবই পানসে ছিল।
উপলব্ধি করলো, দুজন হুডওয়ালা রিকসায় চড়লেই আগ্রহ এবং
ভালোবাসা হয় না। হয়ত আন্তরিকতা আসে, হয় সুন্দর কিছু
মুহুর্ত। সত্যিকারের ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। ধীরে ধীরে অজান্তে
জন্মায়। খুব পবিত্র আর নির্মল। যে পেয়েছে সে কতটা ভাগ্যবান তা শুধু যে হারিয়েছে সে
জানে।
কিন্তু আর না! এখন মনে হচ্ছে, ধুম করে বয়সের চেয়েও আদিত্য অনেক বেশি ম্যাচিউরড হয়ে গিয়েছে। কারো হীনমন্যতা খুব একটা গায়ে লাগে না আর। গত
একমাস ধরে কেন যেন নিজেকে রিকাভার্ড লাগছে ওর। ঘোরাঘুরি, গান,
লেখালেখি, পড়াশোনা, মেডিটেশন কিংবা জিম নিয়ে নিজেকে অনেক ব্যস্ত করে ফেলার চেষ্টা করে আসছে। নিজের পরিবার, আত্নীয়-পরিজন, খুব কাছের বন্ধু আর
শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে অনেক ভালো সময় পার হয়ে যায়। এতকিছুর পরে একটিবারও যে নিজেকে শেষ করে দেয়ার
চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়নি- ভাবলেই ওর নিজস্বত্ত্বার প্রতি নিজের শ্রদ্ধা বাড়ে। বিশ্বাস রেখেছিল নিজের উপর। নোংরা আর মিথ্যায় ভরা জীবনটা আসলে মোটেই সুন্দর না। কিন্তু সুন্দর করে নিতে হয়। আপন মনের মধ্যেই
সবচে সুন্দর ফুলের বাগান বানিয়ে নিতে হয়। আদি বুঝে গেছে নিজেকে ভালোবাসাটা অনেক বেশি দরকার
জীবনে। কিন্তু আত্মকেন্দ্রিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে না। রাগ, অভিমান,ক্ষোভ বা আফসোস নেই কারো বা কিছুর প্রতি। অনুভূতিগুলো পালটে গেল শুধু।
শুধু কোন কিছুকেই সবকিছু বানিয়ে ফেলা জীবন না, কিছু
কিছুকে নিয়ে সবকিছু হওয়াটাই জীবন। ভালো-মন্দ নিয়েই জীবন। কে বা কোনটা কতটুকু
অনুভূতির ভাগিদার সেটা বুঝতে শিখে গেল ছেলেটি। প্রতিটি মানুষ শুধুই এক একটি অভিজ্ঞতা
এখন।
এইতো বেশ ভালো আছে আদি !
এইতো বেশ ভালো আছে আদি !

Comments
Post a Comment