ভালে পড়ল ভাই-ফোঁটা

ভালে পড়ল ভাই-ফোঁটা
--
শুভ কর্মকার
মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তনে যে সকল বিষয় তাকে পূর্ণ করার প্রচেষ্টায় আবিস্কৃত ও প্রচলিত সেগুলোই ধীরে ধীরে তার সভ্যতার আচার-অনুষ্ঠানের মর্যাদা পায় আর তা নিয়েই মানুষের আবেগ অনুভূতিগুলো দাপিয়ে বেড়ায় শতাব্দী থেকে শতাব্দী, দিগন্ত হতে তেপান্তর, গেঁথে থাকে তার প্রান সঞ্চারনের মধ্যবিন্দু হয়ে, কাজ করে গভীর হতে

 
তেমনই একটি উৎসব হল ভাই-ফোঁটাশাস্ত্রীয় অভিধানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠান"। কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে (কালীপুজোর  দুইদিন পরে) এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। চলে ৭দিন ধরে। বরাবরই হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত হলেও আজ অসাম্প্রদায়িকভাবে সর্বস্তরে সমাদৃত ।  পুরানে যমুনা ও যমের সহোদরীয়  ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে  ঈশ্বর যমকে  মৃত্যুরাজ  করেন। কথিত আছে, এদিন মৃত্যুর দেবতা  যম তাঁর যমজ বোন  যমুনার(যমী) হাতে ফোঁটা নিয়েছিলেন ।  অন্যমতে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন । আর তাই বোনের বিশ্বাস যমের বোন যমুনা যেমনি করে ভাই-ফোঁটা দিয়ে তার ভাইকে  মৃত্যুঞ্জয়ী করেছে, সেও আয়ুস্কামনা করে ভাইকে যমের হাত থেকে রক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী করে তুলবে । সেই প্রার্থনায় শ্লোক পড়ে --
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যম-দুয়ারে পড়ল কাঁটা,
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা।
ভাইবোন দুজন দুজনের মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনায় প্রার্থনা করে ঈশ্বরের কাছে।


কিন্তু আমার কাছে সম্পর্কটি তার চেয়েও বিশেষ কিছু। ভাতৃত্ব  অটুট রেখে রাখী বাঁধে নতুন বন্ধন, মাঝে মাঝে নতুন করে বাঁচার আশা জাগায়,  মনে হয় না, আমি অপূর্ণ না"। অন্তত বোন  যার নাই সে দিদি/আপু/বোন বলে ডাকতে পারে আবার ভাই নেই যার সে ভাই বলতে  পারার অবলম্বন পায় । পূর্ণ হয় দুটি প্রানের চাওয়া । কবিগুরু তার বোন সৌদামিনী, শরতকুমারী, সুকুমারী, স্বর্ণকুমারী ও বর্ণকুমারীর কাছ থেকে ভাইফোঁটা নিতেন ।   জাত-পাত-ধর্ম ভুলে সবার একত্মতার জন্য তিঁনি বৃহতাকারে পুনঃপ্রচলন করেন রাখী উৎসবভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে ভাই-ফোঁটা দেওয়া বোনদের অবশ্য কর্তব্য । এমনকি, যেসব মেয়েদের ভাই নেই, তাঁদেরও চন্দ্র দেবতাকে ভাই মনে করে ভাই-ফোঁটা পালন করতে হয় । নদিয়া  জেলার বিরহী গ্রামে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মদনগোপালের মন্দির ৷  দীপাবলির পর  ভ্রাতৃ-দ্বিতীয়ার দিন প্রতি ঘরে ঘরে যখন বোনেরা ভাইদের ফোঁটা দিতে ব্যস্ত থাকেন, সেই মন্দিরের বিগ্রহ কৃষ্ণকে ভাই জ্ঞানে  মেয়েরা ফোঁটা দেন ৷ যাঁদের ভাই নেই তাঁরা চলে আসেন এই মন্দিরে ফোঁটা দিতে  আবার যাঁদের দিদি বা বোন নেই তাঁরাও চলে আসেন ফোঁটা নিতে ৷ বোন খুঁজে পায় ভাইকে আর ভাই খুঁজে পায় বোনকে ৷ এ যেন পরকে আপন  করার এক উৎসব৷
অনেকের মনে হতে পারে সহোদর না হয়ে এসব আচার-অনুষ্ঠানে কি ভাই-বোন পাতানো সম্ভব? আমার মনে হয় রক্তের হিসেব করতে গেলে স্বয়ং ভগবানও আমাদের কিছু হোন কিনা তাতো অনেক দূরের কথা, তার অস্তিত্ব আছে কিনা তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসবে, আর  উত্তর যদি  কিছু থেকে থাকে তা হল আত্মা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক। আমার আত্মা নেই বরঞ্চ একটি শরীর আছে, আমি নিজে আত্মা এবং সেই স্থুল শরীরটির  নিয়ন্ত্রক । আত্মার  বন্ধনে আমরা সবাই শৃঙ্খলিত ।  বিজ্ঞানের ভাষায় Collective Unconscious অনুযায়ী DNA অথবা যে কোনো মাধ্যমে  জালের মত  প্রত্যেকে একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত, সবারই মূল এক। 

ছোটবেলাথেকে বড় বোনের  অভাব খুব অনুভব করতাম ।  স্কুলে  ক্লাসের প্রায় সবারই দিদি ছিল, আমার ছিল না    দিদিরা হোম-ওয়ার্ক করে  দিতেন ছোট ভাইদেরকে, স্কুলে  নিয়ে আসতেন, জীবনে  অন্ধের যষ্ঠির মত গাইড দিতেন, দুষ্টামি-খেলার সাথী ছিলেন তাদের দিদিরা । বছরের পর বছর তারা সবাই ভাইফোঁটা পেত । পেতাম না আমি (কখনই)   কারণ নিজের বোন ছিলনা ।  না বুঝে যখন ভাইফোঁটা নিতে শিশুমন হাজারো  তালবাহানায়  বিরক্ত, স্পষ্টমনে আছে তখন  দিদা(নানী)  আমাকে "ভাইয়া"  ডেকে ভাইফোঁটা  দিতেন । দুধের আঁশ ঘোলে মিটাতেন । এসব কিছুর  পরেও অপূর্নতাতো থেকেই  যায় । কিন্তু  এত বছর  পরে এবারের ভাইফোঁটা  এল জীবনের বিশেষ একটি দিন হয়ে ।  রীতিমত আচার করে বাঁচার আঁশ বেড়ে গেল, সম্পর্ক আরো গভীর হল । জানিনা ঈশ্বর  আয়ু বাড়ান কিনা    তবে  মহাপ্রকৃতির কাছে প্রার্থনা  রবে যা দিয়েছো তা কেড়ে নিওনা    কখনই না    আজীবন ভাই-বোন যাতে ভাল থাকি । সহস্রবর্ষী বটের শেকড়ের চেয়েও মজবুত হোক আমাদের রাখীবন্ধন । পারস্পরিক বিশ্বাস  হয়ে উঠুক সকলের সমাদৃত ।  বিশ্বভ্রাতৃত্ব হোক সার্বজনীন ।
ভাই-ফোঁটায় সকলের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা...

Comments

Popular posts from this blog

সুরের ভেলার ভেসে চলা - সঙ্গীতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ(ভারতীয় সঙ্গীত) : শুভ কর্মকার

সে এক কিশোরের গল্প - শুভ কর্মকার

আমার-আপনার বাঙালির রবি নজরুল... - শুভ কর্মকার